সময় সংবাদ লাইভ রিপোর্ট: জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, “যদি বিএনপি অন্যদের সঙ্গে একমত না হয়, আর সেটাকেই যদি বেঠিক বলা হয়, তাহলে সেটি গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রের মূলভাবই হচ্ছে মতের ভিন্নতা।”১৭ বছর পর বিবিসি বাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
সোমবার প্রথম পর্ব প্রকাশের পর মঙ্গলবার প্রকাশিত এই অংশে তিনি সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, ১১ দফা প্রস্তাব, এবং রাজনৈতিক জোটের অভ্যন্তরীণ মতভেদ নিয়ে খোলামেলা বক্তব্য দেন।
বিবিসি বাংলার সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন সংস্কার ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু দলের মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে, বিএনপি যদি ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ দেয়, তাহলে কি সেটা সমস্যা হিসেবে দেখা উচিত?
জবাবে তারেক রহমান দৃঢ়ভাবে বলেন, “আমাকে যদি অন্যের সঙ্গে একমত হতে হয়, তাহলে সেটাই গণতন্ত্র? আর আমি যদি দ্বিমত করি, সেটি বেঠিক হয়, এটা তো গণতন্ত্র না। গণতন্ত্র মানে হচ্ছে বিভিন্ন মত থাকবে। অনেক বিষয়ে আমরা একমত হবো, কিছু বিষয়ে নাও হতে পারি। এই মতের ভিন্নতাই গণতন্ত্রের মূল সারবস্তু— এটাই তো দ্য এসেন্স অফ ডেমোক্রেসি।”
তিনি আরও যোগ করেন, “বিএনপি কখনোই গণতন্ত্রের মূল চেতনা থেকে সরে আসেনি। আমরা বরং সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে লালন করি যেখানে সমালোচনাও শোনা যায়, ভিন্নমতও প্রকাশ পায়।”
সংস্কার ইস্যুতে বিএনপি গোপন বা দ্বৈত অবস্থান নিচ্ছে কি না এমন প্রশ্নে তারেক রহমান সরাসরি জবাব দেন, “আমরা কিছু লুকোচ্ছি না। আমি যা মনে করছি, যেটা আমার দৃষ্টিতে ঠিক না সেটা খোলাখুলিভাবে বলছি। এতে কারও প্রতি অসম্মান দেখানোর প্রশ্নই আসে না। বরং এটা হচ্ছে দায়িত্বশীল রাজনৈতিক আচরণ।”
তারেক রহমান বলেন, “বিএনপি সংস্কারের পক্ষে, কিন্তু সেই সংস্কার যেন জাতীয় স্বার্থ ও গণতন্ত্রের ভিত্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয় সেটি নিশ্চিত করতেই দল সতর্ক অবস্থান নিচ্ছে।”
“সবাই এখন সংস্কারের কথা বলছেন। কিন্তু যখন বাংলাদেশে স্বৈরাচার চলছিল, তখন আমরা সেই স্বৈরাচারীদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, দেশে সংস্কার দরকার। তখন তো কারও মুখে ‘সংস্কার’-এর ‘স’-ও শোনা যায়নি,” বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিবিসি বাংলা জানতে চায়, বিএনপি কেন একজন ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে।
জবাবে তারেক রহমান বলেন, “এটা এমন না যে আমরা সংস্কারের বিপক্ষে। আমরা প্রশ্ন তুলেছি, এই সংস্কারগুলো কাদের উদ্দেশ্যে, কোন প্রেক্ষাপটে, এবং জনগণের অনুমোদন আছে কি না। গণতন্ত্র মানে হলো জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে উপরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো রুল নয়।”
তিনি বলেন, ‘বিএনপি গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে চায় ব্যক্তি কেন্দ্রীক রাজনীতি নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যারা একনায়কতন্ত্র চালু করেছিল, তারা তখন সংস্কারের নামে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছিল। আমরা সেই ফাঁদে পা দিতে চাই না। সংস্কার অবশ্যই দরকার, কিন্তু সেটি হতে হবে জনগণের ইচ্ছা ও সংবিধানের আত্মার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন করা হয়।
তারেক রহমান বলেন, বিএনপি চায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও পারস্পরিক সম্মানজনক সম্পর্ক।
“আমরা ভারতবিরোধী নই। আমরা সমান মর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক চাই। দুই দেশের জনগণের স্বার্থই যেন অগ্রাধিকার পায় সেটাই আমাদের অবস্থান। ভারত যদি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও জনগণের প্রত্যাশাকে সম্মান করে, তাহলে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে,” বলেও জানান তিনি।
বিবিসি জানতে চায়, চলমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিএনপির অংশগ্রহণ বা সংস্কারের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে তারেক রহমান কী ভাবছেন।
জবাবে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এখন এক ধরনের সংস্কারের জোয়ার এসেছে, কিন্তু আমি বলব সংস্কার শুধু কাগজে-কলমে নয়, মানসিকতায় আনতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক হতে হবে, অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে জবাবদিহিতা আনতে হবে।”
তিনি মনে করেন, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অবস্থান বা দলীয় স্বার্থে সংস্কার করা হলে সেটি টেকসই হবে না।
তারেক রহমান বলেন, “আমরা এমন সংস্কার চাই যা জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে, প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করবে, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করবে।”
তারেক রহমান বলেন, ‘বিএনপি কখনোই কোনো জোটের অংশীদার হিসেবে নিজের নীতি-আদর্শ বিসর্জন দেয়নি। আমরা জোট করি দেশের স্বার্থে, কিন্তু আমাদের নীতি ও অবস্থান অটল। ভিন্নমত মানেই বিভেদ নয় এটি হলো চিন্তার পরিপক্বতা।’
তিনি আরও বলেন, “যারা মনে করেন বিএনপি অন্য দলের সঙ্গে সব বিষয়ে একমত হবে, তারা গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণাটাই ভুলভাবে বোঝেন। মতের ভিন্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক। একদলীয় চিন্তাই বরং গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।”
২০০৮ সালের পর এই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে এমন দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিলেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত এই নেতা গত এক যুগের বেশি সময় ধরে দলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিবিসি বাংলার সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারে তার বক্তব্যে পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে বিএনপি নিজেদের রাজনৈতিক দর্শনে কোনো সমঝোতা করতে রাজি নয়, তবে সংলাপ ও মতবিনিময়ের দরজা খোলা রাখতে চায়।
সাক্ষাৎকারের শেষাংশে তারেক রহমান বলেন, “আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারে। গণতন্ত্র মানে সবার সম্মতি নয়, বরং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা।”
তিনি যোগ করেন, “বাংলাদেশে আমরা যদি প্রকৃত গণতন্ত্র চাই, তাহলে প্রথমেই আমাদের ভিন্ন মতকে সম্মান করতে হবে। এটাই হবে সংস্কারের প্রথম ধাপ, এটাই হবে সত্যিকারের পরিবর্তন।”